প্রভাষ আমিন :আমি প্রথম কলকাতা তথা ভারতে গেছি ২০১৩ সালে। নয়াদিল্লিতে ব্যাকপেইনের চিকিৎসা শেষে রাজধানী এক্সপ্রেসে কলকাতা। তবে সেবার কলকাতায় থাকতে পেরেছিলাম মাত্র ১২ ঘণ্টা। দ্বিতীয় দফায় কলকাতা গিয়ে নিউমার্কেটের বাইরে কোথাও যাওয়া হয়নি। তৃতীয় দফায় গিয়েছিলাম পিঙ্ক টেস্ট কাভার করতে। সেবার বেশির ভাগ সময় কেটেছে ইডেন গার্ডেনেই। প্রায় ৫০-এ প্রথম কলকাতা গেলেও এ শহরটি ছেলেবেলা থেকেই আমার খুব চেনা। আমাদের ছেলেবেলা কেটেছে সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ বসু, সমরেশ মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু, বুদ্ধদেব গুহ, ফাল্গুনী, নীহাররঞ্জন, শঙ্কর, সত্যজিৎ পড়ে। মান্না, হেমন্ত, মানবেন্দ্র, শ্যামল, জগন্ময়, সন্ধ্যা শুনে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো আমাদের অস্তিত্বজুড়ে। কাজী নজরুল, জীবনানন্দও ছড়িয়ে আছেন কলকাতার অলিগলিতে। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের বাঁকে বাঁকেও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে কলকাতার নাম। তাই আগে তিনবার গেলেও কলকাতা ঠিক দেখা হয়নি। কলকাতাকে কাছ থেকে দেখার এবং অনুভব করার একটা তৃষ্ণা বয়ে বেড়াচ্ছিলাম বুকের ভিতর। এবার তাই পরিকল্পনা করলাম অন্তত সাত দিন থেকে কলকাতাকে কাছ থেকে দেখব। শেষ পর্যন্ত অবশ্য চার দিন থাকতে পেরেছিলাম। ৪০০ বছরের একটি শহরকে চার দিনে দেখা সম্ভব নয়। তবে যে চার দিন ছিলাম, মাইলের পর মাইল হেঁটেছি ইতিহাসের সন্ধানে। ভাগ্য খারাপ বলতে হবে, এত প্রস্তুতি নিয়ে এবার কলকাতা গিয়ে পড়েছিলাম ছুটির ফাঁদে। তাই অনেক কিছুই একদম কাছ থেকে দেখার সুযোগ মেলেনি।
পরদিন আমরা বের হলাম বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশের খোঁজে। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র পাতায় পাতায় রয়েছে কলকাতা। এ কলকাতাই বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতিবিদ হিসেবে গড়ে তুলেছে। তিনি পড়তেন ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান মৌলানা আজাদ কলেজ), থাকতেন বেকার হোস্টেলে। দেশভাগের উত্তাল সময়টা বঙ্গবন্ধু কলকাতায় ছিলেন। পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। চোখের সামনে দেখেছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নির্মমতা। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠার সময়টা গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছায়ায় বেড়ে ওঠা। কলকাতায় তিনি সান্নিধ্য পেয়েছেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, আবুল হাশিমদের। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় কাছ থেকে দেখেছেন মহাত্মা গান্ধীকেও। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ইসলামিয়া কলেজ আর বেকার হোস্টেলের কথা তো আছেই, আছে প্রায় নিয়মিত সোহরাওয়ার্দীর থিয়েটার রোডের বাসায় যাতায়াতের কথা। আছে পার্ক সার্কাস, ধর্মতলা, এসপ্লানেড, গড়ের মাঠ, হাওড়া স্টেশনসহ নানান স্মৃতির গল্প। গুগল ম্যাপে ঠিকানা খুঁজে সদর স্ট্রিট থেকে হাঁটা শুরু করলাম। সদর স্ট্রিট থেকে রফি আহমেদ কিদওয়ানী রোড- মিনিট দশেকেই পৌঁছে গেলাম মৌলানা আজাদ কলেজে। আবারও ছুটির ফাঁদে। কোনোরকমে গেটের ভিতরে ঢুকে পরশ নেওয়ার চেষ্টা করলাম বঙ্গবন্ধুর। আগেই জেনেছি বেকার হোস্টেল, আজাদ কলেজের কাছেই। বাংলাদেশের ইতিহাসে যেখানে বারবার উঠে আসে বেকার হোস্টেলের কথা, সেখানে স্থানীয়রা সেটি চিনতেই পারলেন না। আবারও দ্বারস্থ হলাম গুগল ম্যাপের। কলকাতার এদো গলির পথ ধরে হাঁটছি আর ভাবছি, এ রাস্তায় বঙ্গবন্ধু হাঁটতেন। সঙ্গের তাপসদা আর অলকদা গলির অবস্থা দেখে একটু সন্দেহই প্রকাশ করলেন। কিন্তু মিনিট দশেকের মধ্যে পেয়েও গেলাম ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত বেকার হোস্টেল। ছায়াঢাকা, পাখিডাকা বেকার হোস্টেলের নিরিবিলি পরিবেশ বেশ মন টানল। কিন্তু এখানেও ছুটি। বেকার হোস্টেলে বঙ্গবন্ধুর কক্ষটি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। খোলা থাকলে হয়তো দেখতেও পেতাম। নিচ থেকেই দেখলাম তিন তলার দক্ষিণ দিকের বঙ্গবন্ধুর কলকাতার আবাসস্থল। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এক জায়গায় আছে, বঙ্গবন্ধু গভীর রাতে সোহরাওয়ার্দীর থিয়েটার রোডের বাসা থেকে বেকার হোস্টেলে ফিরছেন। এটা তাঁকে প্রায় নিয়মিতই করতে হতো। আর আমরা ভরদুপুরে বেকার হোস্টেল থেকে থিয়েটার রোডের পথ ধরলাম। থিয়েটার রোডের এখনকার নাম শেকসপিয়র সরণি। বঙ্গবন্ধুর লেখায় বারবার থিয়েটার রোড এসেছে, সোহরাওয়ার্দীর বাড়ি বলে। তবে এ থিয়েটার রোডের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিবিড়। বাংলাদেশের আঁতুড়ঘরটি এখন পরিচিত শ্রী অরবিন্দ ভবন হিসেবে। এ ভবনেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচালিত হয়েছে প্রবাসী সরকারের কার্যক্রম। ছুটি থাকায় সেই ভবনের ভিতরেও যাওয়া হলো না।
বন্ধু দেবদীপ পুরোহিতের আমন্ত্রণে এক সন্ধ্যায় গেলাম তাঁর অফিসে। দেবদীপ দ্য টেলিগ্রাফের ডাকসাইটে সাংবাদিক। সেই ভবনটিও ইতিহাসের অংশ। একই ভবনে আনন্দবাজার পত্রিকা, দেশ, সানন্দারও অফিস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতার সাংবাদিকরাও বাংলাদেশের মুখপাত্র ছিলেন। আনন্দবাজারও ছিল বাংলাদেশের মুখপত্র। দেশ-সানন্দা একসময় বাঙালি মধ্যবিত্তের অবশ্যপাঠ্য ছিল। আনন্দবাজার ভবনটি যেন একটি ইতিহাসের সংগ্রহশালা। পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে কত বড় বড় সাহিত্যিক আর সাংবাদিকের স্মৃতি। আমাদের বসিয়ে রেখেই কাজ সারলেন দেবদীপ। তারপর তাঁর গাড়িতেই রাতের কলকাতা দেখা। চলতি পথেই দেখলাম ইডেন গার্ডেনের কোনায় আকাশবাণী ভবন। ’৭১ সালে আকাশবাণী আর দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর। ঘোরাঘুরি শেষে কলকাতা প্রেস ক্লাবের সামনের সবুজ চত্বরে বসল ম্যারাথন আড্ডা। গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিতে দিতে ভাবছিলাম, এ কলকাতা প্রেস ক্লাবও তো জড়িয়ে আছে আমাদের জন্মের সঙ্গে। ’৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কলকাতা থেকে গাড়িবহরের যাত্রা হয়েছিল এ প্রেস ক্লাব থেকেই। কলকাতার সাংবাদিকরাও ছিলেন আমাদের যুদ্ধসাথী।
কলকাতার মানুষ দেখলে আমি সবসময় মনে মনে মাথা নুয়ে শ্রদ্ধা জানাই। ’৭১-এ এ কলকাতা বাংলাদেশের কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে কলকাতা থেকে। কলকাতার বয়স্ক মানুষ দেখলে মনে হয় ’৭১ সালে নিশ্চয়ই তিনি আমাদের পক্ষে ছিলেন। তরুণদের দেখলে মনে হয়, নিশ্চয়ই তার পূর্বসূরিদের কেউ বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধে পাশে ছিলেন।
ডিহি কলকাতা, গোবিন্দপুর আর সুতানটি গ্রাম থেকে যে কলকাতার যাত্রা, একসময় তা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। দেশভাগের আগে অবিভক্ত বাংলার প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতা। এখন যেমন বাংলাদেশের মানুষ পড়াশোনা বা ভাগ্যবদলের আশায় ঢাকায় আসে, ১৯৪৭-এর আগে যেত কলকাতায়। কাঁটাতারের বেড়ায় যত বিভক্তিই থাকুক, ইতিহাস তো আর মুছে যাবে না। এ কলকাতার পথে পথে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, সোহরাওয়ার্দী, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ। সুযোগ পেলে, ভিসা পেলে ইতিহাসের পথে হাঁটতে আবার যাব কলকাতায়। বারবার যাব সিটি অব জয় কলকাতায়।
লেখক : সাংবাদিক । সূএ : বাংলাদেশ প্রতিদিন